মুসলিম বিশ্বের উপর বড় দুটি ফেতনা এবং ঝড় এসেছে, যা তার ভিত্তি মূলে আঘাত করেছে।
একটিকে সামলে নিয়ে ইসলাম আবার পথ চলেছে আর অন্যটি প্রতিরোধ করার মতো শক্তি, সামর্থ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়নি।
প্রথমটি তাতারী ফিতনা দ্বিতীয়টি পশ্চিমা আগ্রাসন যা শিল্পবিপ্লবের পরে শুরু হয়।
সপ্তম হিজরীতে তাতারীদের দ্বারা সমৃদ্ধ নগরী বাগদাদ পতন এবং সুদীর্ঘ সুসংহত আব্বাসি খেলাফত ধ্বংসের আলোচনা করে জনৈক সাহিত্যিক বলেন, দু’টি মূহুর্তের নিখুঁত সূচনাকাল নির্ধারণ করা সম্ভব নয়; ব্যক্তিজীবনে নিদ্রা আর জাতীয় জীবনে অধঃপতন।
ইসলামের ইতিহাসে মুসলিম বিশ্বের উপর যত বিপদ ও দুর্যোগ নেমে এসেছে তার মধ্যে তাতারী হামলাই ছিলো সবচেয়ে ভয়াবহ ও মর্মন্তুদ। তাতারীরা পূর্ব দিক থেকে পঙ্গপালের মত ধেয়ে এসেছিলো এবং সমগ্র মুসলিম জাহান ছেয়ে গিয়েছিলো।
তাতার সেনাবাহিনী প্রথমে বোখারাকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে। এরপর সমরকন্দের উপর আক্রমণ করে এবং শহরের একজন অধীবাসীও তাদের হাতে জীবিত রক্ষা পায়নি। তারা একে একে রে,হামদান, কযভীন,মার্ভ ও নিশাপুর পদাবনত করে।
হিজরী সপ্তম শতকে আব্বাসি খেলাফতের বাহিরে খাওয়ারিযম শাহী সালতানাত ছিলো খুবই প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী। সুলতান আলাউদ্দিন মুহাম্মাদ খাওয়ারিযম শাহ ছিলেন সৎ,দীনদার, বীর ও দৃঢ়চেতা শাসক।
তা সত্বেও এই সাম্রাজ্যও তাতারীদের গতিরোধ করতে সক্ষম হয়নি। ফলে প্রাচ্য ভুখন্ডে তাতারীদের প্রতিরোধ করার মতো তখন আর কোন শক্তি ছিলো না।
ইরান ও তুর্কিস্তান তছনছ করার পরে তাতারীরা ‘দারুল খিলাফত’ বাগদাদের দিকে শ্যেনদৃষ্টিতে তাকায় এবং ৬৫৬ হিজরীতে চেঙ্গিস খানের পৌত্র হালাকু খান বাগদাদ আক্রমণ করে বসে।
ঐতিহাসিকগণ বাগদাদ ধ্বংসের ইতিহাস লিখতে গিয়ে মনোবেদনা ও হৃদয়-যন্ত্রণা চেপে রাখতে পারেননি।
ইবন কাসির লেখেন, ৪০ দিন পর্যন্ত বাগদাদে গণহত্যা ও ধ্বংসের রাজত্ব চলে। নগর-উদ্যান, যা পৃথিবীর সুন্দরতম ও সমৃদ্ধতম নগর ছিলো, এমন ধ্বংস ও বিরান হয় যে, অলিতেগলিতে লাশের স্তুপ পড়ে থাকে।
ঐতিহাসিক ইবনুল আসির তার হতবিহ্বল অবস্থা ‘আল কামিল’ গ্রন্থে উল্লেখ্য করে লেখেন, এ ঘটনা এমনই লোমহর্ষক ও হৃদয়বিদারক ছিলো যে, কয়েক বছর আমি এ সম্পর্কে ‘লিখবো কি লিখবো না’ এ দ্বিধাদ্বন্দ্বেই ছিলাম।
হায়! আমার যদি জন্মই না হতো, কিংবা এর পূর্বেই আমার মৃত্যু হতো এবং আমার অস্তিত্ব বিস্মৃত হয়ে যেতো।
পারস্যের কবি শেখ সাদী যিনি বাগদাদে পড়াশোনা করেছেন এবং এর শান-শওকত দেখে এসেছেন, তিনিও বাগদাদের পতনে মনোবেদনা সহ্য করতে না পেরে একটি মর্মস্পর্শী মর্ছিয়া (শোকগাথা) রচনা করেন। মূলত এই শোকগাথাটি সকল মুসলমানের হৃদয়ের প্রতিধ্বনি যা কুল্লিয়াতে সাদী গ্রন্থে স্থান পেয়েছে।
দারুল খেলাফত বাগদাদ পতনের পর তাতারীরা দামেস্ক আক্রমণ করে দখল করে নেয় এবং মিসরের দিকে অগ্রসর হয়।
মিসরের সাহসী সুলতান আল মালিকুল মুজাফফার সাইফুদ্দীন কুতুয বুঝতে পারলেন যে,এখন মিসরের পালা। তিনি এক সাহসী ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন যে, মিসরে অবস্থান করে আত্মরক্ষার চেয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়ে তাতারীদের উপর আক্রমণাত্মক হামলা চালানো হবে।
অবশেষে ৬৫৮ হিজরীর পবিত্র রমজান মাসের ২৫ তারিখ আইনে জালূত নামক স্থানে তাতারীদের সঙ্গে মুসলিম বাহিনীর তীব্র সংঘর্ষ হয় এবং মুসলমানদের বিজয় হয়। তাতারীরা পলায়ন করে অনেকে বন্দিও হয়।
আইনে জালুতের যুদ্ধের পর দামেস্কের সুলতান আল মালিকুজ জাহির বায়বার্স তাতারীদের শাম এলাকা থেকে উৎখাত ও বহিষ্কার করতে সক্ষম হোন।
সূয়ুতি তারিখুল খুলাফা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আইনে জালুতের যুদ্ধের পর ‘তাতারীদের পরাজয় অসম্ভব’ এই প্রবাদ মিথ্যা সাব্যস্ত হয়।
তাতারীরা ছিলো প্রাণবন্ত,পরিশ্রমী, যাযাবর দূর্ধর্ষ ও রক্তলোলুপ। কিন্ত এই মূর্খ অসভ্য বর্বর জাতির না ছিলো কোন আসমানি ধর্ম ও আসমানি কিতাব, না ছিলো কোন সভ্যতা সংস্কৃতি,জ্ঞান-বিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তি।
ফলে কতিপয় অজ্ঞাত, অখ্যাত ও নিবেদিতপ্রাণ মুবাল্লিগের দাওয়াত ও তাবলীগের মেহনতে তাতারীদের মধ্যে ইসলাম গ্রহণের ধারা শুরু হয় এবং মহান আল্লাহ্তালার ফজল-করম,অনুগ্রহ-অনুকম্পায় এক সময় সমস্ত তাতারী জাতি ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আগমণ করেন।
উল্লেখ্য যে, ইতিহাস গ্রন্থ পাঠে জানা যায় তাতারীদের মধ্যে ইসলামের পাশাপাশি খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু হয় কিন্ত মহান আল্লাহ্ তার অপার অনুগ্রহে তাতারীদের ভাগ্যে ইসলাম এবং একত্ববাদই নির্ধারণ করে রাখেন।
তাতারীদের নেতা চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর তার সাম্রাজ্য চার পুত্রের মধ্যে ভাগ করে দেন। জ্যেষ্ঠ পূত্র জূজী খানকে সাম্রাজ্যের পশ্চিম অংশ,হালাকু খানের নেতৃত্বে থাকে পারস্যের ঈলখানিয়া শাসনাধীন অঞ্চল,চুগতাঈ খানের অধীনে মধ্যাঞ্চল এবং ঊগতাঈ খানের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যের পূর্বাঞ্চল।
এই শাখায় মঙ্গু খান ও কুবলাঈ খানের মত প্রসিদ্ধ সেনাপতির জন্ম হয়।
এই চার ভাগেই জোড়েশোড়ে দাওয়াত ও তাবলীগের কাজ শুরু হয় এবং এক শতাব্দীর মধ্যেই সকল তাতারী জাতিগোষ্ঠী ইসলামে দিক্ষিত হয়। যাদের হাত এক সময় মুসলিমদের রক্তে রঞ্জিত হয় তাদের হাতেই ‘তাসবিহ’ শোভা পায়।
preaching of Islam (দাওয়াতুল ইসলাম নামে অনূদিত) গ্রন্থের লেখক টি. ডব্লিউ. আর্নল্ড লেখেন, মোঙ্গলদের মধ্যে প্রথম ইসলাম গ্রহণ করেন বারাকা খান(১২৬৭ খৃ.)।
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি সুলতান গিয়াসুদ্দীন নাম ধারণ করেন। বোখারা থেকে আগত দু’জন শ্রমিকের থেকে ইসলামের শিক্ষা,নীতি-মালা এবং বিধি-বিধানের বর্ণনা শুনে তিনি ইসলাম কবুল করেন।
ইবন কাসির আল বিদায় ওয়ান নিহায়া গ্রন্থে লেখেন, ৬৯৪ হিজরীতে চেঙ্গিস খানের পৌত্র কাযান সম্রাট মনোনীত হয় এবং আমীর তুযানের হাতে প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণ করে মাহমুদ নাম ধারণ করেন এবং জুমার জামাতে অংশগ্রহণ করেন।
ইসলামের একনিষ্ঠ দাঈ ও মুবাল্লিগগণ কী কী পন্থায় তাতারীদের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত ও তাবলীগের মহান খেদমত আঞ্জাম দিয়েছেন এবং তাতারীরা কিভাবে মুসলিম হয়েছেন, এসকল ইতিহাস জানতে হলে পাশ্চাত্য ঐতিহাসিক গীবন, হাউসেন এবং আর্নল্ড প্রমূখের ইতিহাস গ্রন্থ পাঠ করাই যথেষ্ট।
তাতারীদের মধ্যে খ্যাতনামা আলিম-ফকিহ্, মুজাহিদ-মুবাল্লিগ এবং সূফী-সাধকের আগমণ ঘটেছে যারা দুর্যোগ ও সংকটময় মূহুর্তে ইসলামের রক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
আল্লাহ তায়ালার যে সকল একনিষ্ঠ বান্দার দাওয়াত ও তাবলীগের বদৌলতে এই বর্বর ও বন্য জাতি, যারা এক সময় মুসলিম জাহান ও খেলাফতকে ধ্বংস করে দিয়েছিল, তারাই আবার ইসলামের মুহাফিজ বা ত্রাতা হিসেবে আবির্ভূত হলো।
ইতিহাসে যদিও এ সকল নিবেদিতপ্রাণ দাঈ,মুবাল্লিগদের স্থান হয়নি কিন্তু তাদের অনুগ্রহ কেবল মুসলিম উম্মাহর উপর নয় বরং কিয়ামত পর্যন্ত সকল মানবতার জন্য জারি থাকবে।
তাতারী জাতির ইসলাম গ্রহণের দ্বারা প্রমাণিত হলো, ইসলাম শত্রুকে জয় করে প্রেমে আবদ্ধ করবার আশ্চর্য ক্ষমতা রাখে।
কবি ইকবাল বলেন, তাতারীদের সৃষ্ট বিপর্যয় থেকে প্রমাণিত হলো যে, মন্দির থেকে কাবা তার রক্ষক খুঁজে পেয়েছে।
ইসলামের আধ্যাত্মিক শক্তি,সৌন্দর্য ও বৈশিষ্ট্য আলোচনা করে খ্যাতনামা দাঈ,দার্শনিক সাইয়্যিদ আবুল হাসান আলী নদবী র. দাবি করেন, ইতিহাস পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যেখানে ইসলামি সেনাবাহিনী আগমণ করেনি বরং অজ্ঞাত অখ্যাত কতিপয় জীর্ণ বস্ত্রের দরবেশরা তাবলীগের কাজ করেছেন সে অঞ্চলের অধিবাসীরা আজ মুসলিম সংখ্যাগুরু।
আর যে অঞ্চলে মুসলিম সেনাবাহিনীর আগমন ঘটেছে সে সকল অঞ্চলে আজ মুসলিমরা সংখ্যালঘু।
সূত্র: যুগান্তর