প্রধান বিরোধী দল বিএনপির অনুপস্থিতিতে আসন্ন নির্বাচনে ‘বিপুল ভোটার উপস্থিত’ করে একটি ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ।
অনেকেই মনে করছেন, বিরোধী দল-বিহীন নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো হবে আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নির্দেশনা মেনে মাঠ পর্যায়ের নেতারা ভোটার টানার নানা কৌশল নিয়ে প্রস্তুত হচ্ছেন।
বাংলাদেশের সর্বউত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের একটি সংসদীয় আসনে ঘুরেছেন বিবিসি বাংলার সংবাদদাতা। সেখানে তিনি জানার চেষ্টা করেছেন, আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ভোটার কেন্দ্র আনার জন্য কী ধরণের পরিকল্পনা সাজিয়েছেন।
পঞ্চগড়-১ আসনটি বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের ৩০০ আসনের তালিকায় এক নম্বরে আছে। নির্বাচনী প্রচারণা শুরু না হলেও ভোট নিয়ে সারাদেশের মতো আলোচনা আছে পঞ্চগড়ের রাজনীতি সচেতন সাধারণ মানুষের মধ্যে।
স্থানীয় ভোটারদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, নির্বাচন নিয়ে তাদের মধ্যে খুব একটা আগ্রহ নেই।
ভোট দিতে মানুষের কতটা আগ্রহ থাকবে?
“সাধারণ মানুষ তো বুঝতেছে এটা তো কোনো ভোট না, এটাতো একটা পাতানো ভোট,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন পঞ্চগড়ের এক বাসিন্দা।
আরেকজন বলছিলেন, “যারা আমলীগ করে তারাই ভোট দিতে যাবে, বিএনপির লোকগুলো যাবে না মনে হয়।”
ভোটার আনতে কৌশল
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির বাড়ানোর দলীয় কৌশল বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপি নির্বাচন বর্জন করার পরেও নির্বাচনে ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ দেখানোর জন্য নিজ দল থেকেই নেতাদের স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে।
পঞ্চগড়-১ আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনীত প্রার্থী মোঃ নাঈমুজ্জামান ভুঁইয়া। তিনি ছাড়াও মনোনয়ন বঞ্চিত বর্তমান সংসদ সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মজাহারুল হক প্রধান স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন।
এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাটও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন। আসনটিতে বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা এখন পর্যন্ত ১১ জন।
নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বাড়িয়ে ‘অংশগ্রহণমূলক’ দেখানোর কৌশল বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা।
পঞ্চগড়-১ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মোঃ নাঈমুজ্জামান ভুঁইয়া এলাকায় কর্মীদের নিয়ে ভোটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
উঠান বৈঠক, কর্মীসভা এবং আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে নির্বাচনের দিন ভোটার উপস্থিতি নিয়ে।
সাতই জানুয়ারি ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে কী পরিকল্পনা হয়েছে?
এ প্রশ্নে নাঈমুজ্জামান ভুঁইয়া বিবিসি বাংলাকে বলেন, তাদের মাঠ পর্যায়ে প্রস্তুতি সম্পন্ন। ছক অনুযায়ী কাজ শুরু হবে ভোটের আগে।
“পঞ্চগড় এক আসনে মোট ১৫৬টি ভোটকেন্দ্র আছে। আমরা প্রত্যেকটি ভোটকেন্দ্রের বিপরীতে ৩০০ আওয়ামী লীগ কর্মী নিয়ে কেন্দ্র কমিটি গঠন করেছি”
“আমাদের যে ৩০০ কর্মী তাদের পরিবারের চারজন করেও যদি ভোটে আনে তাহলে ১২শ ভোট। স্রেফ আমার কর্মীদের দ্বারাই এক কেন্দ্রে ১২শ ভোটার আনা সম্ভব। এখন ১২শর সঙ্গে ১৫৬ আপনি গুন দেন,” বলেন নাঈমুজ্জামান ভুঁইয়া।
অতীত ভোটের হিসেব বলছে পঞ্চগড়-১ আসনটিতে বিএনপির ভালো জনমর্থন এবং ভোটার রয়েছে । যেহেতু বিএনপি নির্বাচনে থাকছে না তাই ভোটার উপস্থিতি বাড়ানো নিয়েই কৌশলী আওয়ামী লীগ প্রার্থী।
নাঈমুজ্জামান ভুঁইয়া জানালেন, কেন্দ্র-ভিত্তিক পরিকল্পনার সাথে ভোটের প্রচার কৌশলও এবার আলাদা।
“যারা শিক্ষকতা করে, মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিন, আলেম সমাজ, আমাদের নারী স্বাস্থ্যকর্মী যাদের এলাকায় পরিচ্ছন্ন ইমেজ রয়েছে, এরকম একটা টিম নিয়ে আমরা বাড়ি বাড়িতে ভোট ভিক্ষা চাইব”
“বৈষ্ণবদের মতো করে ভিক্ষা চাইব আর তাবলীগ জামাতের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে দাওয়াত দেব,” বলেন মি. ভুঁইয়া।
“এই এরকম একটা স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আমার কর্মী বাহিনী সাজিয়েছি। তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজের একদল সাহসী মানুষ তারা অপশক্তিকে প্রতিরোধ করবে আর আমাদের মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণ নেতাদের নিয়ে একটা উপদেষ্টা পরিষদ করেছি। এই তিন ক্যাটাগরিতে আমাদের কর্মী বাহিনী বিন্যাস করেছি।” বলছিলেন নাঈমুজ্জামান ভুইয়াঁ।
তৃণমূল নেতাদের ভূমিকা
বিএনপির নেতা-কর্মীরা ভোটকেন্দ্রে আসবেন না, আবার বাধা দেয়ারও শঙ্কা রয়েছে। তাই ভোটের মাঠে তৃণমূলের ঐক্য এবং সক্রিয়তা হবে গুরুত্বপূর্ণ।
কেন্দ্র এবং দলীয় প্রার্থীর কৌশল ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে মাঠ পর্যায়ের এ নেতাকর্মীদের মাধ্যমে।
এবার জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তৃণমূল পর্যন্ত নির্বাচন পরিচালনা কমিটি করেছে। সারাদেশে গঠন করা হয়েছে চল্লিশ হাজারের বেশি কেন্দ্রভিত্তিক কমিটি। দলের সব ইউনিট ও সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীদের এ নির্বাচনে ভোটার টার্নআউট নিশ্চিত করতে কাজ করবে বলেই তৃণমূলে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
তেঁতুলিয়া, আটোয়ারি এবং সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত পঞ্চগড়-১ আসনের মোট ভোটার ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার। তেঁতুলিয়া আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানার চেষ্টা ছিল তারা কীভাবে ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখবেন ।
তেঁতুলিয়া সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সুরুজ্জামান জানান তারা প্রস্তুত আছেন। স্থানীয় ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনার জন্য তারা সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন।
“আমরা বিভিন্ন গ্রামে ওয়ার্ডে মিটিং করে বেড়াচ্ছি যে ভোট অবশ্যই দিতে হবে। কারণ দেশের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার জন্য আমাদের ভোটকেন্দ্রে যাবার বিকল্প নেই।”
তেঁতুলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও সাবেক চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম মিঞা বলেন তাদের বক্তব্য বোঝা যায় বিরোধী দলের সমর্থক বা বিএনপির ভোটারদেরকেও ভোটকেন্দ্রে আনতে চান তারা।
“আমরা বলবো ঠিক আছে আপনি নৌকাকে পছন্দ করেন না, নৌকার প্রার্থী যে আছে তাকে পছন্দ করেন না তাহলে যাকে পছন্দ তাকে দেন। কিন্তু ভোট দেন। আপনার মতামতটা পেশ করেন। এটাই আমাদের বক্তব্য থাকবে।”
পঞ্চগড়ে উপজেলাভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা কমিটি আছে আওয়ামী লীগের। তেঁতুলিয়া উপজেলা কমিটির একজন উপদেষ্টা কাজী মাহবুবুর রহমান বলছেন ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোর কেন্দ্রীয় টার্গেট বাস্তবায়নে তফসিল ঘোষণার আগে থেকে তাদের প্রস্তুতি চলছে।
“যেকোনোভাবে হোক আমরা ভোটারদেরকে সেন্টারে নিয়ে আসবো। ভোট কাকে দেবে এটা তাদের ব্যক্তিগত বিষয়। এবং এজন্য আমাদের নিজস্ব কিছু টেকনিক আছে। যেমন ধরুন যেটা সবাই জানেন যে ভোটারদের আনার জন্য যে যানবাহন দরকার সেগুলো আমার সরবরাহ করবো।”
তবে বিএনপির অংশগ্রহণ ছাড়া এ নির্বাচনে সাধারণ ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আনা কঠিন হবে বলেই অনেকে মনে করছেন। আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতারাও বিষয়টি নিয়ে ভাবনার মধ্যে আছেন।
পঞ্চগড়-১ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত সম্রাট।
তিনি স্বীকার করেন, বিএনপি বিহীন ভোটে যতদল আর প্রার্থী থাকুক না কেন, মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। এ কারণে স্বতন্ত্র প্রার্থী নির্বাচনের মাঠে থাকতে হবে বলেই জোর দেন তিনি।
“আমরাতো ভোটারদেরকে বলপ্রয়োগ করে সেন্টারে নিয়ে আসতে পারবো না। মানুষের একটা আগ্রহ থাকতে হবে। ভোটারদের আগ্রহ থাকতে হবে। যেমন আমি মানুষের সেন্টিমেন্টটা বুঝি আমিতো জনপ্রতিনিধি ছিলাম অনেকদিন। এইজন্য আমার ধারণা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের থাকতে হবে,” বলেন মি. সম্রাট।
তিনি আশংকা করছেন, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মাঠে না থাকলে নির্বাচনে ১০ শতাংশ ভোটার কেন্দ্র যাবে কি না সন্দেহ আছে।
“এটা আপনারা মাঠ জরিপ করলে দু’চারজনের সঙ্গে কথা বললে বুঝতে পারবেন। টেন পার্সেন্ট না, ফাইভ পার্সেন্টও যায় কি না সন্দেহ আছে। এটা আমাদের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে গেছে।”