ছবির উৎস, Getty Images
মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর থেকেই আলোচনায় পাশের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা। দুই ক্ষেত্রেই এবছর আগের বছরগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। যা নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-বিশ্লেষণ।
এই ফলাফলের পেছনে শিক্ষায় ঘাটতি, শিক্ষাবর্ষের মাঝখানে হঠাৎ কারিকুলাম পরিবর্তন নাকি রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা-এমন নানা বিষয় আসছে আলোচনায়।
এবার মোট ১৯ লাখ ৪ হাজার ৮৬ শিক্ষার্থী মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় অংশ নেয়। এর মধ্যে পাশ করেছে ১৩ লাখ ৩ হাজার ৪২৬ জন। ফেল করেছে ৬ লাখ ৬৬০ ছাত্রছাত্রী। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এবারের সর্বনিম্ন পাশের হার বরিশাল বোর্ডে, যা মাত্র ৫৬ শতাংশ।
প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার ফলাফলে গড় পাসের হার ৬৮ দশমিক ৪৫ শতাংশ, জিপিএ-৫ পেয়েছে ১ লাখ ৩৯ হাজার ৩২ জন শিক্ষার্থী।
২০২৪ সালে পাশের হার ছিল ৮৩ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। আর জিপিএ ফাইভ পেয়েছিলেন এক লাখ ৮২ হাজার ১২৯ জন।
গত ১৫ বছরের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষায় ২০১০ সালের পর থেকে সংখ্যাগতভাবে ধারাবাহিক ক্রম উন্নতিতে বিপরীত দৃশ্য এবছর।
কেউ কেউ এই ফলাফলকে বিপর্যয় হিসেবে উল্লেখ করছেন, আবার অনেকের মতে এবার যথার্থ মূল্যায়ন হয়েছে বলেই প্রকৃত চিত্র উঠে এসেছে।
যদিও ফলাফলের সংখ্যাগত এই পরিবর্তনকে বিপর্যয় বা যথার্থ মূল্যায়ন, এমন দৃষ্টিতে দেখছেন না বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ। তারা বলছেন, “সংখ্যাগত দিক বিবেচনায় নিলেও লার্নিং গ্যাপের বিষয় নিয়ে তেমন আলোচনা নেই।” এছাড়া যোগ্য শিক্ষক ও শিখন পদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তারা।
তারা বলছেন, এই ফলাফলের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিতিশিলতা, খাতা মূল্যায়নে স্বল্প সময়, শিক্ষার্থীদের লার্নিং গ্যাপ, বারবার কারিকুলামে পরিবর্তন, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মসহ নানা কারণ রয়েছে।
শিক্ষাবিদ ও গবেষকদের অনেকে মনে করেন, বর্তমান কিংবা অতীতের কোনো সরকারই শিক্ষা খাতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। আর এ কারণেই দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা একটি চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে।
তাদের প্রশ্ন, “গ্রাম বা শহরের সুযোগসুবিধা বা বৈষম্য বিবেচনায় নিয়ে কি আমরা পরিকল্পনা করি?”
“একই প্রশ্নে সবার পরীক্ষা নিই আমরা, কিন্তু সবার সুযোগ তো এক না। এ কারণেই এবারও অতীতের মতো গ্রামের শিক্ষার্থীদের ফলাফল তুলনামূলক খারাপ হয়েছে,” বলেও মনে করেন তারা।
ছবির উৎস, Getty Images
ফলাফল নিয়ে যা বলছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
এবছর এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার ফল প্রকাশ ঘিরে আনুষ্ঠানিকতা ছিল বেশ সীমিত। আগের বছরগুলোর মতো সরকার প্রধানের কাছে হস্তান্তর কিংবা আয়োজন করে মন্ত্রীদের সংবাদ সম্মেলন এবার দেখা যায়নি।
বৃহস্পতিবার দুপুরে মতবিনিময় শেষে সংবাদ সম্মেলনে ফলাফল প্রকাশ করেন বাংলাদেশ আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির প্রধান এবং ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দোকার এহসানুল কবির।
ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, যশোর, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড এবং বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড একযোগে ফল প্রকাশ করা হয়।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এবারের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় সব বোর্ডেই গণিতে খারাপ করেছেন শিক্ষার্থীরা। যার প্রভাব পড়েছে সার্বিক পাশের হারে।
দেশের ১১ শিক্ষা বোর্ডে প্রায় ২৩ শতাংশ ছাত্রছাত্রী গণিতে ফেল করেছেন। ইংরেজিতেও ভালো করতে ব্যর্থ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী।
ছবির উৎস, Getty Images
ফল খারাপের কারণ হিসেবে নানা যুক্তি তুলে ধরছেন শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তাদের কেউ কেউ বলছেন, শিক্ষাবর্ষের মাঝখানে হঠাৎ কারিকুলাম পরিবর্তনে অনেকের প্রস্তুতি ঠিকঠাক ছিল না।
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আন্দোলনসহ নানা কারণে শিক্ষার্থীদের বড় একটি সময় অনিশ্চতায় কেটেছে, যা ফল বিপর্যয়ের কারণ হিসেবে মনে করেন অভিভাবকদের কেউ কেউ।
কানন শিকদার নামে একজন অভিভাবক বলেন, “আন্দোলন আন্দোলন করে তো মাঝের দুই মাস ছেলে লেখাপড়াই করেনি।”
আশা অনুযায়ী ফল করতে পারেননি বরিশালের শিক্ষার্থী ফরিদ বিশ্বাস। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, অংকে মার্ক কম পাইছি, পরীক্ষার প্রশ্ন একটু কঠিন ছিল।”
পরীক্ষার খাতা চ্যালেঞ্জ করার কথাও বিবিসি বাংলাকে জানান অনুত্তীর্ণ কয়েকজন শিক্ষার্থী।
যদিও বরিশালের হালিমা খাতুন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গনিতের শিক্ষক মোহাম্মদ এনামুল হক বলছেন, “প্রশ্ন কঠিন ছিল দাবিটি সঠিক নয়, তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো ফল কিভাবে করলো?”
তিনি বলছেন, “অনেক স্কুলে বিষয়ভিত্তিক ভালো শিক্ষক না থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হচ্ছে।”
দূর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ হওয়ায় স্কুলে ঠিকমতো শিখছে না শিক্ষার্থীরা। “আমার দেখা একজন ইংরেজি শিক্ষক তার সনদও নাই, নিবন্ধনও নাই কিন্তু চাকরি করে যাচ্ছে, তাহলে সে কি শেখাবে,” বলেন মি. হক।
এবছর শিক্ষকদের পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল বলেও জানা গেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মাধ্যমিক স্কুলের একজন শিক্ষক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “এবার খাতা দেখার ব্যাপারে অন্য সময়ের তুলনায় বেশি স্ট্রিক্ট (কঠোর) ছিলাম।”
ছবির উৎস, Getty Images
‘রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খারাপ ফলাফলের কারণ’
কয়েক বছরের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, বাংলাদেশে মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষায় পাসের হার টানা প্রায় দেড় দশক ধরে বেড়েছে।
২০১০ সাল থেকে দেশে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি চালু করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। ওই বছর মাধ্যমিকে গড় পাশের হার ছিল ৮০ দশমিক ৭৪ শতাংশ। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ৮০ শতাংশের ওপর পাশের হার দেখা যায়।
২০২১ এর করোনা অতিমারির সময় পাশের হার দাড়ায় ৯৩ দশমিক ৫৮ শতাংশ। যদিও সেবার মাধ্যমিক অটোপাশ দেওয়া হয়েছিল। এরপর ২০২৩ সালে পাশের হার কিছুটা কমে ৮০ দশমিক ৩৯ শতাংশ হলেও গত বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে পাশের হার হয় ৮৩ দশমিক ০৪ শতাংশ।
এবছর পরিস্থিতি ভিন্ন হওয়ার পেছনে মোটাদাগে পাঁচটি বিষয়কে কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ।
তারা বলছেন, পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নে কড়াকড়ি, রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি, খাতা মূল্যায়নে স্বল্প সময়, শিক্ষার্থীদের লার্নিং গ্যাপ, বারবার কারিকুলাম পরিবর্তনে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতিতে ঘাটতি এই বিষয়গুলো এবারের ফলফলে প্রভাব ফেলেছে।
এছাড়া যোগ্য শিক্ষকের ঘাটতি এবং শিক্ষক প্রশিক্ষণের অভাবকেও দায়ী করছেন অনেকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ বিবিসি বাংলাকে বলছেন, “পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে সরকারের পলিসির কারণে এবছর পাশের হার কিংবা জিপিএ-৫ কম হতে পারে।”
অতীতে রাজনৈতিক বিবেচনায় নিজেদের সফলতা দেখাতে পাশের হার ও জিপিএ-৫ বাড়িয়ে দেখানোর প্রবণতা ছিল বলেও মনে করেন তিনি।
ছবির উৎস, Getty Images
মি. রশিদের মতে, “মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ওভার মার্কিং বা আন্ডার মার্কিং ইস্যুতে ধিরে ধিরে একটি সঠিক জায়গায় আসার চেষ্টা করবে সরকার। এ বছর পাশের হার যতটা হয়েছে সামনের বছর এই হার এর থেকেও কম হতে পারে,” বলেও মনে করেন তিনি।
যদিও, “পাশের হার কম হওয়া মানেই শিক্ষার কোয়ালিটি (মান) বেড়ে গেল তাও কিন্তু না,” বলেন মি. রশিদ।
শিক্ষাক্রম বারবার পরিবর্তন হওয়াও ফলাফল খারাপ হওয়ার একটা কারণ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষক।
তিনি বলছেন, “২০২১ সালের কারিকুলাম থেকে আমরা হঠাৎই ২০১২ সালের কারিকুলামে ব্যাক করেছি। এই কারিকুলাম সম্পর্কে শিক্ষকরাই অবগত না বা অ্যাসেসমেন্ট (মূল্যায়ন) নিয়েও ওয়াকিবহাল না। সুডেন্টরাও ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারেনি।”
দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিও খারাপ ফলাফলের কারণ হিসেবে মনে করেন শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক আব্দুস সালাম। তিনি বলছেন, “পরীক্ষার আগেই রাজনৈতিক অস্থিতিশিলতা ছিল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অস্থিতিশিলতা ছিল।”
অবশ্য ফলাফল নিয়ে বাড়তি গুরুত্ব দেয়ার পক্ষে নন এই গবেষক। তিনি বলছেন, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরণের গলদ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ভুল পথেই চলছে। যেখানে নম্বরকেই অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় শেখার বিষয়কে নয়, বলেন মি. সালাম।
তিনি বলছেন, “আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতি আরো নমনীয় করে, পারফরমেন্স ভিত্তিক মূল্যায়ন পদ্ধতির দিকে যাওয়া উচিৎ। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূর করার কথাও বলছেন তিনি।”
এছাড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, নিয়োগ বানিজ্য বন্ধ ও বেতন বৃদ্ধির বিষয়ও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।