ছবির উৎস, Majid Saeedi/Getty Images
“ইসরায়েল যখন হামলা চালাল, সেটা আমার কাছে সব থেকে ভয়াবহ মুহূর্ত ছিল না। যখন ওই হামলার পরেও আমার সেলের দরজাটা খোলা হল না, সেটাই ছিল আমার কাছে এমন একটা সময়, যেন নরকের দিকে যাচ্ছি আমি।”
মোতাহরেহ গুনেই ২৩শে জুনের সেই হামলার দিনটার অভিজ্ঞতা শোনাচ্ছিলেন বিবিসিকে।
ইসরায়েল যখন ইরানের এভিন কারাগারে হামলা চালায়, সেই সময় রাজনৈতিক কর্মী মিজ গুনেই ওই জেলেই বন্দি ছিলেন।
তাকে সেই সময়ে একটা কক্ষে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। বর্তমানে কিছুদিনের জন্য তাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
বিবিসি নিউজের ফার্সি বিভাগ এমন কিছু উপগ্রহ চিত্র, প্রত্যক্ষদর্শীর বয়ান আর যাচাই করা ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করেছে, যার ফলে ওই ইসরায়েলি হামলার ব্যাপারে কিছু নতুন তথ্য উঠে এসেছে।
ইরান-ইসরায়েল সংঘর্ষের শেষ পর্যায়ে এসে জুন মাসে ইসরায়েল ওই জেলে হামলা চালায়। ওই হামলায় নিহতদের তথ্য সামনে উঠে এসেছে।
ছবির উৎস, Supplied
‘মনে হচ্ছিল আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে’
উত্তর তেহরানে অবস্থিত কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে মোড়া ওই কারাগারে বিগত ৫০ বছরে হাজার হাজার রাজনৈতিক বন্দিকে আটক করে রাখা হয়েছে।
যারা সরকারের নীতির বিরোধিতা করে, তাদেরই এই কারাগারে বন্দি করে রাখে ইরান সরকার। জুন মাসে ইরানের যে কয়েকটি জায়গায় ইসরায়েল হামলা চালিয়েছিল, তার মধ্যে এই জেলের ওপরে হামলাতেই সব থেকে বেশি মানুষ মারা গিয়েছিলেন।
ইরানের কর্মকর্তাদের মতে এভিন জেলের ওপরে হামলায় ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। এদের মধ্যে যেমন জেলের কর্মীরা ছিলেন, তেমনই কয়েদি, চিকিৎসা-কর্মী, বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে আসা মানুষ এবং জেলের কাছাকাছি থাকা মানুষেরও মৃত্যু হয়েছিল ওই হামলায়।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউমান রাইটস ওয়াচ ১৪ই অগাস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে লিখেছে যে ওই কারাগারের ওপরে নির্বিচারে হামলা চালিয়েছিল ইসরায়েল।
এ ধরনের হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং যুদ্ধ-অপরাধের আওতায় আসে বলে বর্ণনা করেছে হিউমান রাইটস ওয়াচ।
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স জানিয়েছে, “ওই জেলটিকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা অভিযানের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছিল বলেই সেটিকে চিহ্নিত করে আক্রমণ করা হয়েছে।”
যে সময়ে বিস্ফোরণ হচ্ছিল, সেই মুহূর্তগুলোর বর্ণনা দিতে গিয়ে মিজ. গুনেই বলছিলেন, “যখন তিন নম্বর বিস্ফোরণের শব্দ আমার কানে এলো তখন আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম যে বাইরে বেরনোর আর কোনো উপায় নেই। গায়ের পুরো শক্তি দিয়ে আমি গরাদে ধাক্কা দিচ্ছিলাম, কিন্তু খুলতে পারিনি। মনে হচ্ছিল আমার জীবনের শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে এসেছে, বিশ্বকে বিদায় জানানোর সময় হয়ে এসেছে।”
শেষমেশ অন্য এক বন্দি তার কুঠুরির গরাদটা খুলে দেন। হোঁচট খেতে খেতে তিনি এগোচ্ছিলেন, কিন্তু ঘন ধোঁয়ায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।
তার কথায়, গোড়ার দিকে নিরাপত্তাকর্মীরা বন্দিদের বাইরে বেরোনো আটকাতে চেষ্টা করেছিল, জেলের কয়েকজন অফিসার তো হুমকিও দিচ্ছিলেন।
ছবির উৎস, Majid Saeedi/Getty Images
‘কয়েদিরাই আহত অফিসারদের সাহায্য করে’
কয়েদিরা যখন আহত রক্ষীদের সহায়তা করার জন্য দৌড়ঝাঁপ করছিলেন, সেটা দেখে মোতাহরেহ গুনেইয়ের মনে হয়েছিল যে একেই বলে মানবিকতা।
হামলার আকস্মিকতায় বিহ্বল হয়ে যাওয়া একজন নারী অফিসারকে শান্ত করার চেষ্টা করছিলেন মিজ গুনেই। আবার একজন আহত পুলিশ কর্মকর্তার চোটে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিয়েছিলেন তিনি।
জেলের হাসপাতালে আটকিয়ে পড়া ডাক্তার আর নার্সদের সহায়তা করতে ছুটেছিলেন অন্য একটা ওয়ার্ডের বন্দিরা।
হামলায় আহত এক চিকিৎসক সৈদাহ মাকরম পরে ইনস্টাগ্রামে লিখেছিলেন, “যে কয়েদিদের আমি হয়তো কখনো চিকিৎসা করেছিলাম, তারাই আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।”
এভিন জেলে আটক অন্য এক নারী বন্দি বিবিসির সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানান, “গোড়ার দিকে একের পর এক জোরালো বিস্ফোরণ হচ্ছিল প্রায় মিনিট দুয়েক ধরে। হামলা শুরুর পরেই আমি বিছানায় শুয়ে পড়ি কারণ জানলাগুলো টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। তারপরে উঠে পোশাক পরে নিই। আমরা সবাই মিলে বয়স্ক নারীদের নিচে নামাতে সহায়তা করছিলাম। জেলের তরফে কেউ আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। তারা তো উল্টে দরজা বন্ধ করে রেখে বলছিল যে আমরা বাইরে বেরতে পারব না।”
নিরাপত্তার কারণে আমরা এই নারীর নাম প্রকাশ করছি না।
ছবির উৎস, BBC / Supplied
ছয়টা ক্ষেপণাস্ত্র ফেলা হয়েছিল
বিবিসির বিশ্লেষণে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে এভিন কারাগারে ইসরায়েল অন্তত ছয়টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিল। এর ফলে জেলের পরিধির ভেতরে অন্তত ২৮টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স, আইডিএফ দাবি করে–– ‘ইরানের মানুষের ওপরে নিপীড়নের প্রতীক’ ছিল ওই কারাগারটি।
তারা আরও দাবি করছে যে জেলটির ওপরে হামলায় যাতে নাগরিকদের যতটা সম্ভব কম ক্ষয়ক্ষতি হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা হয়েছিল।
বিস্ফোরণের কয়েক মিনিট পরেই জেলে আটক এক রাজনৈতিক বন্দির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন তার এক আত্মীয়। তার সঙ্গে কথা বলে ওই ঘটনার একটা অন্য বর্ণনা জানতে পেরেছে বিবিসি।
তার কথায়, “জেল থেকে যারা বাইরে বেরিয়ে আসছিলেন, তারা বলছিলেন যে চারদিকে লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। কয়েকজন কয়েদি বাইরে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু তারা কেউ পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন না। সবাই কিছুটা হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন।”
ইরানের কর্মকর্তারা বলছেন যে ওই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির মধ্যে ৭৫ জন কয়েদি পালিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। এদের মধ্যে কয়েকজনকে পরে আবারও আটক করা হয় অথবা তারা নিজেরাই ফিরে আসে।
কর্মকর্তারা এটাও বলছেন যে ওই হামলায় নিহত ৮০ জনের মধ্যে ৪২ জন জেলের কর্মচারী ও পাঁচজন কয়েদি। শুধু নিহত জেল কর্মকর্তাদের নামই প্রকাশ করা হয়েছে।
তবে বিবিসি নিউজ ফার্সি বন্দিদের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলে তিন জন নিহতের পরিচিতি এবং কী অবস্থায় তাদের মৃত্যু হয়েছিল, তা পৃথকভাবে খোঁজ চালিয়ে নিশ্চিত করেছে। এরা হলেন:
- মসুদ বেহবহানি: ইরান ও আমেরিকার দ্বৈত নাগরিক ছিলেন নিহত এই বন্দি। তার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অপরাধের অভিযোগ ছিল। তার মৃত্যুর বিষয়ে পরিবারকে স্পষ্ট করে কোনও তথ্য দেননি ইরানি কর্মকর্তারা।
- অরউইন মোহাম্মদি (৩৭ বছর বয়সী): জেলে আটক তার বাবার জামিনের কাজে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি।
- মেহরঙ্গিজ ইমানপুর (৬১ বছর বয়সী): একজন প্রসিদ্ধ শিল্পী ও চিত্রকর। গায়ে বারুদের টুকরো ছিটকে এসে লাগলে তিনি মারা যান।
নিহত অন্যদের মধ্যে একজন স্থানীয় নারী রয়েছেন। তার সন্তান মাত্র একবছর বয়সী।
নিহতদের মধ্যে একজন সামাজিক কর্মকর্তাও আছেন, যিনি এক বন্দির মুক্তির জন্য জেলের কাছে গিয়েছিলেন।
বাকিদের মধ্যে রয়েছেন পাঁচজন সামাজিক কর্মকর্তা, ১৩ জন কমবয়সী সেনা সদস্য এবং একজন সামাজিক কর্মকর্তার পাঁচ বছর বয়সী শিশু।
এভিন জেলে হামলার পরে সেখানে আটক তৃতীয় লিঙ্গের কয়েদিদের ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে প্রায় একশো জন তৃতীয় লিঙ্গের কয়েদি নিহত হয়েছেন ওই ইসরায়েলি হামলায়। তবে বিবিসি নিউজ ফার্সির স্বতন্ত্র তদন্তে জানা গেছে যে ওই দাবিটা ভুল ছিল।
ইরানের তৃতীয় লিঙ্গের বন্দিদের অবস্থার ওপরে নজর রাখেন এমন একজন আইনজীবী রেজা শাফাখাহ বিবিসিকে বলেছেন, “তাদের অবস্থা নিয়ে গভীর চিন্তা আছে। কেউ জানে না যে ওই কয়েদিরা কোথায় আছেন।”
ছবির উৎস, MAXAR
বিবিসির প্রশ্নের জবাব দেয়নি ইসরায়েল
ইসরায়েল দাবি করেছে যে তাদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা অভিযান আর নজরদারি চালানোর জন্য ওই কারাগারটি ব্যবহৃত হচ্ছিল।
বিবিসি ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের কাছে প্রশ্ন করেছিল যে হামলা চালাতে কোন অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল এবং ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কি এই আশঙ্কা ছিল না যে হামলায় সাধারণ নাগরিকরাও মারা যেতে পারেন?
কিন্তু ইসরায়েলের তরফে এই দুটির কোনোটিরই জবাব দেওয়া হয়নি।
হামলার এক মাস পরে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ওই ঘটনা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
অ্যামনেস্টির রিসার্চ, অ্যাডভোকেসি, পলিসি অ্যান্ড ক্যাম্পেইন বিভাগের সিনিয়র পরিচালক এরিকা গুয়েভারা রোসেস বলেন, “আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালানোর ওপরে কড়া নিষেধাজ্ঞা আছে। এই ধরনের হামলা যদি জেনে-বুঝে পরিকল্পনা করে চালানো হয়, সেটা যুদ্ধাপরাধের মধ্যে পড়ে।”
জাতিসংঘের মানবাধিকার কার্যালয় বলেছে যে এভিন কারাগার ‘কোনও সামরিক লক্ষ্যস্থল ছিল না’ এবং এই হামলা আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন।