বাংলাদেশের পার্বত্য জেলা বান্দরবানের রুমা উপজেলায় মঙ্গলবার রাতে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির পর থানচি উপজেলায় দুটি ব্যাংকে আজ হানা দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। এসময় হামলাকারীরা স্থানীয় বাজার ঘিরে রেখে ফাঁকা গুলি বর্ষণ করেছে বলে জানা গেছে। তবে সোনালী ব্যাংকের রুমা শাখা থেকে কোনো অর্থ লুট হয়নি বলে জানিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
ঘটনার পর বুধবার ঢাকায় সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান থানচির দুটি ব্যাংকে হামলার কথা নিশ্চিত করেছেন। এসময় তিনি ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টকে (কেএনএফ) দায়ী করেন।
এ ঘটনার পর বান্দরবানের সোনালী ব্যাংকের ছয়টি শাখা সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
বান্দরবানের রুমা উপজেলার সোনালী ব্যাংকের শাখা থেকে কোনো টাকা লুট হয়নি বলে জানিয়েছে ব্যাংকটির সিইও অ্যান্ড ম্যানেজিং ডিরেক্টর আফজাল করিম। বিবিসি বাংলাকে তিনি বলেন, ওই ব্যাংকের ভল্টে থাকা সব টাকা অক্ষত আছে। থানচিতেও তারা ভল্ট ভাঙতে পারেনি। তবে সেখানে তখন লেনদেন চলছিল। সে টাকাগুলো তারা নিয়ে গেছে।
থানচিতে এই ঘটনা এমন সময় ঘটলো যখন রুমা উপজেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স ভবনের ব্যাংক থেকে অপহৃত ব্যাংক কর্মকর্তাকে উদ্ধারের জন্য আজ ভোর রাত থেকে যৌথ বাহিনী ওই অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।
একইসাথে রুমা উপজেলায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনে ছিলেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন।
বান্দরবানের জেলা পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বিবিসি বাংলাকে বলেছেন ডাকাতির ঘটনাটি তারা খতিয়ে দেখছেন।
থানচি উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান চসা থোয়াই মারমাসহ কয়েকজন জনপ্রতিনিধি বিবিসি বাংলার কাছে ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তবে কারা এই হামলা চালিয়েছে সে বিষয়ে তাৎক্ষণিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তারা।
থানচির একজন জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন, বেলা সাড়ে এগারটার দিকে সশস্ত্র ডাকাতরা থানচি বাজার ঘিরে ফেলে এবং এরপর অস্ত্রের মুখে লোকজনের ফোন কেড়ে নিয়ে ব্যাংকে ঢুকে পড়ে। এর বাইরে আর কোনো মন্তব্য করতে তিনি রাজি হননি।
যদিও জানা গেছে ব্যাংকে প্রবেশ করে নিরাপত্তাকর্মীদের অস্ত্র কেড়ে নেয়ার পর কাউন্টার এবং গ্রাহকদের কাছ থেকেও টাকা নিয়ে যায় ডাকাতরা।
প্রসঙ্গত, থানচি বাজারের সাথেই থানা ও বিজিবির ক্যাম্প ছাড়াও কাছেই সেনাবাহিনীর একটি চেকপোস্ট আছে।
স্থানীয়রা অবশ্য বলছে অল্প সময়ের মধ্যেই ভীতিকর অবস্থা তৈরি করে দুই ব্যাংকে হামলা করে ডাকাতদল ওই এলাকা ছেড়ে যায়।
কুকি-চিন বা কেএনএফকে দায়ী করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ঢাকায় সচিবালয়ে এক ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান রুমা ও থানচিতে ব্যাংকে হামলার জন্য কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকে দায়ী করেছেন।
“ইদানীংকালে কুকি চিন বিভিন্নভাবে অবস্থান জানান দিচ্ছিলো। রুমায় সোনালী ব্যাংকে ঢোকার আগে তারা বিদ্যুতের সাব স্টেশন বন্ধ করে। এরপর সোনালী ব্যাংকে অগ্রসর হয়। আজ আবার তারা থানচিতে কৃষি ও সোনালী ব্যাংকে হামলা করেছে। এখন আমাদের অপারেশন চলছে। কত টাকা লুট হয়েছে এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না,” বলছিলেন মি. খান।
তবে কেএনএফ এর দিক থেকে এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য আসেনি।
বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন ও পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন সকালে সাংবাদিকদের বলেছেন যে রুমা সোনালী ব্যাংকের অপহৃত কর্মকর্তাকে উদ্ধারে অভিযান চলছে। এর কিছুক্ষণ পরই থানচি বাজারে হামলা ও দুটি ব্যাংকে ডাকাতির খবর আসে।
প্রসঙ্গত, কেএনএফ এর সাথে গত কিছুদিন ধরে শান্তি প্রতিষ্ঠা নিয়ে একটি কমিটির মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা চলছিলো।
গত পাঁচই মার্চ রুমাতেই বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বাধীন ওই কমিটির সাথে শান্তি আলোচনায় অংশ নেয় কেএনএফ এর একটি প্রতিনিধি দল।
এর আগে গত নভেম্বরে কেএনএফ এর সাথে প্রথম সরাসরি বৈঠক করেছিলো ক্যশৈহ্লা মারমার নেতৃত্বাধীন কমিটি। কমিটিতে সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে অতিরিক্তি জেলা প্রশাসক ও একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার যোগ দিয়েছিলেন। আর কেএনএফের পক্ষে ছিলেন কেন্দ্রীয় সহসভাপতি লাল এং লিয়ান বমের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল।
রুমায় যেভাবে ডাকাতি হয়েছিলো
স্থানীয় পুলিশ জানিয়েছে মঙ্গলবার রাতে রুমা উপজেলা প্রশাসন কমপ্লেক্স ভবনে সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির আগে সেখানকার মসজিদ ঘিরে ফেলেছিলো ডাকাতরা। তাদের গায়ে কেএনএফ এর ইউনিফর্ম দেখেছেন স্থানীয়রা।
হামলাকারীরা দায়িত্বে থাকা দুজন পুলিশ সদস্যকে ব্যারাকে ঢুকিয়ে ফোন ও অস্ত্র কেড়ে নেয়। ব্যারাকের সব পুলিশ সদস্যকে এক ঘণ্টার মতো সেখানে আটকে রাখা হয়।
উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সের যে ভবনে সোনালী ব্যাংক তার নিচতলায় সরকারি কর্মকর্তারা থাকেন আর দ্বিতীয় তলায় ব্যাংকের উল্টো পাশেই থাকেন পুলিশ সদস্যরা।
তবে পরিষদ চত্বরে ঢোকার আগেই ডাকাতরা সেখানকার বিদ্যুতের সাব স্টেশন বন্ধ করে দেয় বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
স্থানীয়রা বলছেন এশার নামাজের সময় মসজিদ ঘেরাওয়ের পাশাপাশি সোনালী ব্যাংকেও অবস্থান নেয় তারা। ডাকাতদের বিশ জনের মতো মসজিদে প্রবেশ করে ব্যাংক ম্যানেজারকে খুঁজতে শুরু করে।
এরপর অস্ত্রের মুখে মুসল্লিদের জিম্মি করে সেখানে থাকা ব্যাংক ম্যানেজার নিজাম উদ্দিনকে নিয়ে যায় ব্যাংকে।
এরপর ব্যাংকের ভেতরে ঢুকে ম্যানেজারের কাছে থাকা চাবি নিয়ে ভল্ট খুলার চেষ্টা করে তারা। তবে সোনালী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছে, শেষ পর্যন্ত ভল্ট ভাঙতে না পারায় কোনো টাকা লুট করতে পারেনি সন্ত্রাসীরা।
ডাকাতি শেষে ব্যাংক ম্যানেজারকে নিয়েই চলে যায় তারা।
ডাকাতরা ব্যাংকের নিরাপত্তায় থাকা পুলিশে দুটি এসএমজি ছাড়াও আটটি অটো চাইনিজ রাইফেল, চারশোর বেশি বুলেট এবং আনসারদের চারটি শটগান ও ৩৫ রাউন্ড বুলেটও নিয়ে গেছে।
মঙ্গলবার রাত নয়টা থেকে সাড়ে নয়টার মধ্যে এসব ঘটনা ঘটে বলে স্থানীয় প্রশাসনের বরাত দিয়ে জানিয়েছেন কেএনএফর সাথে আলোচনার জন্য স্থানীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত শান্তি কমিটির অন্যতম সদস্য সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম।
তিনি জানান ঘটনার পর থেকে থমথমে হয়ে আছে রুমা। দোকানপাট বন্ধ দেখা গেছে এবং লোকজনকেও ঘরের বাইরে আসতে খুব একটা দেখা যায়নি।
ওদিকে পুলিশের আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। সবশেষ খবর অনুযায়ী অপহৃত কর্মকর্তাকে উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে।
কেএনএফ কারা
বাংলাদেশ সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিভিন্ন সময়ে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট বা কেএনএফকে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করে আসছে।
তবে কেএনএফের ঘোষণা ও বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্য অনুযায়ী, বান্দরবান ও রাঙ্গামাটির অন্তত ছয়টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করছে তারা। যদিও দলবদ্ধভাবে তাদের বম হিসেবেও প্রচার করছে অনেকে।
কেএনএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নাথান বম এর নাম গণমাধ্যমে এসেছে। মি. বম এক সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থী ছিলেন এবং বান্দরবানের রুমা উপজেলায় তার বাড়ি বলে জানা যাচ্ছে।
২০২২ সালের দিকে এ সংগঠনটি আলোচনায় আসে। তখন তাদের ফেসবুকে ও ইউটিউব পোস্টে সামরিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও শুরু থেকেই সরকার ও জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে দেখা যাচ্ছিলো।
এরপর স্থানীয় একটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে কেএনএফ সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে একটি কমিটি গঠন করা হয়। সে কমিটি কয়েকটি ভার্চুয়াল বৈঠক শেষে গত নভেম্বরে কেএনএফ এর সাথে সরাসরি আলোচনায় বসতে সক্ষম হয়।
চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহেই উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বিতীয় সরাসরি বৈঠকটি হয়েছিলো।