বাংলাদেশে বিনোদন ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাতি ব্যবহারের জন্য ব্যক্তি মালিকানায় লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন কার্যক্রম স্থগিত করার অন্তর্বর্তীকালীন একটি আদেশ দিয়েছে হাই কোর্ট।
একটি রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে রোববার এই আদেশ দেওয়া হয়।
এর ফলে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নতুন করে কেউ হাতি পালনের লাইসেন্স নিতে পারবেন না।
এছাড়া যাদের কাছে ইতিমধ্যেই লাইসেন্স রয়েছে, তারা সেটি নবায়ন করতে পারবেন না বলেও জানিয়েছেন বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন রিটকারীর আইনজীবী সাকিব মাহবুব।
বাংলাদেশে যে ধরনের হাতি পাওয়া যায়, গবেষকদের কাছে সেটি ‘এশীয় হাতি’ নামেই বেশি পরিচিত। ভারত ও নেপালেও এই প্রজাতির কিছু হাতি রয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
গত কয়েক দশকে আশঙ্কাজনক হারে সংখ্যা কমে যাওয়ায় হাতির এই প্রজাতিকে ‘বিপন্নপ্রায় প্রাণি’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে পরিবেশবাদী সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার (আইইউসিএন)।
তারা বলছে, বাংলাদেশে সব মিলিয়ে আড়াইশোর কিছু বেশি এই হাতি রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০টিরও বেশি হাতি রয়েছে বিভিন্ন মানুষের বাড়িতে।
বন বিভাগের দেওয়া লাইসেন্সের অপব্যবহার করেই সার্কাস, ভ্রমণ, অর্থ উত্তোলন-সহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে প্রায়ই এসব হাতিকে কাজে লাগাতে দেখা যায়।
গত বছর রেল লাইনের ধারে টাকা তোলার সময় ট্রেনের ধাক্কা লেগে গাজীপুরে একটি হাতি মারা যায়। এরকম বিভিন্ন ঘটনায় আগেও অনেক হাতি মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এসব কাজ করার জন্য প্রশিক্ষণের নামে হাতিদের নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এমন কী এগুলো করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে হাতি মারাও যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে বিনোদন ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে এই হাতি পালন বন্ধে গত ১৮ই ফেব্রুয়ারি আদালতে রিট আবেদন করেন অভিনেত্রী জয়া আহসান এবং প্রাণি অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘পিপল ফর অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’।
সেই আবেদনের প্রথমিক শুনানি শেষে রোববার বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ রুলসহ অন্তর্বর্তীকালীন ওই আদেশ প্রদান করেন।
প্রাণি অধিকার রক্ষায় হাই কোর্টের এই আদেশকে একটি ‘মাইলফলক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন প্রাণি অধিকারকর্মীরা।
এর ফলে প্রশিক্ষণের নামে হাতির উপর চালানো নিষ্ঠুরতা বন্ধ হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন রিটের অন্যতম আবেদনকারী অভিনেত্রী জয়া আহসান।
কিন্তু এই আদেশের ফলে আর কী কী পরিবর্তন আসবে? এটি কার্যকরই-বা করা হবে কীভাবে?
আদেশে কী বলা হয়েছে?
প্রাথমিক শুনানির পর ঘোষিত হাই কোর্টের অন্তবর্তীকালীন আদেশে কেবল বিনোদন ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে হাতি পালনের জন্য লাইসেন্স প্রদান ও বিদ্যমান লাইসেন্স নবায়ন কার্যক্রম স্থগিত করার কথা বলা হয়েছে।
একইসঙ্গে, নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে হাতিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও জারি করা হয়েছে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন রিটকারীর আইনজীবী সাকিব মাহবুব।
এছাড়া প্রশিক্ষণের নামে হাতির ওপর নির্যাতন ও অপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, সেটিও রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে বলেন জানান মি. মাহবুব।
বাংলাদেশ সরকারের বনবিভাগ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই রুলের জবাব দিতে হবে বলে বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন মি. মাহবুব।
তবে ঠিক কত দিনের মধ্যে রুলের জাবাব দিতে হবে, সে সব বিষয়ে আদালতের পক্ষ থেকে এখনও বিস্তারিত কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলেও জানিয়েছেন তিনি।
এছাড়া কারা কীভাবে আদেশটি কার্যকর করবে, আদেশ না মানলে কী শাস্তি দেওয়া হবে এবং লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর হাতি কার কাছে হস্তান্তর করতে হবে, সে সব বিষয়ও ঠিক পরিষ্কার নয়।
“আদেশটি মাত্রই ঘোষণা করা হল। ফলে আশা করছি, শিগগিরই এ বিষয়ে বিস্তারিত নির্দেশনা প্রদান করা হবে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. মাহবুব।
যেহেতু এটি একটি অন্তবর্তীকালীন আদেশ, কাজেই এ বিষয়ে সামনে আরও শুনানিও অনুষ্ঠিত হবে।
“আমরা প্রাথমিক ধাপ শেষ করেছি, মূল শুনানি এখনও বাকি রয়েছে। কয়েক মাসের মধ্যেই সেটি অনুষ্ঠিত হবে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. মাহবুব।
ওই শুনানি শেষেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত আদেশ দেওয়া হবে।
“কিন্তু যত দিন না সেই আদেশ ঘোষণা করা হচ্ছে, ততদিন অন্তর্বর্তীকালীন আদেশটিই মেনে চলতে হবে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন আইনজীবী সাকিব মাহবুব।
এ ধরনের আদেশ ঘোষণার মাস তিনেকের মধ্যেই সাধারণত আরেকটি আদেশ দেওয়া হয় বলেও জানিয়েছেন তিনি।
ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা-সহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশেই ব্যক্তি পর্যায়ে হাতি পালন করার চল রয়েছে। হাতির প্রশিক্ষণে ওই সব দেশেও নিষ্ঠুরতার অভিযোগ বিভিন্ন সময় শোনা গেছে।
কিন্তু এই নিষ্ঠুরতা বন্ধে বাংলাদেশেই প্রথম আদালত থেকে কোন নির্দেশনা দেওয়া হলো বলে জানিয়েছে ‘পিপল ফর অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন’।
কী বলছে বন বিভাগ?
বাংলাদেশে ২০১৭ সাল থেকে ব্যক্তি পর্যায়ে হাতি পালনের লাইসেন্স দিয়ে আসছে বন বিভাগ।
মূলত ‘হরিণ ও হাতি লালন-পালন বিধিমালা ২০১৭’ অনুযায়ী এই লাইসেন্স দেওয়া হয়ে থাকে।
আইন অনুযায়ী, ২০ হাজার টাকা লাইসেন্স ফি দিয়ে এবং কিছু শর্ত পূরণ করে এতদিন যে কেউ হাতি পালনের লাইসেন্স নিতে পারত।
শর্তগুলোর মধ্যে রয়েছে হাতি রাখার নির্দিষ্ট জায়গা থাকা, বিচরণ করানোর মতো পর্যাপ্ত চারণভূমি, হাতিকে খাওয়ানো ও রোগের চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি থাকা ইত্যাদি।
সাধারণত প্রতিটি হাতির বিপরীতে আলাদা লাইসেন্স নেওয়া হয়। সক্ষমতা থাকলে একজন ব্যক্তি একাধিক হাতির লাইসেন্স নিতে পারেন।
সাধারণত শখে পোষার জন্য হাতি লাইসেন্স দেওয়ার বিধার রাখা হয়েছিল।
তবে বিনোদন-সহ অন্যান্য অনেক কাজেই সে সব হাতি ব্যবহার করতে দেখা যায়।
‘এমন কী একজনের নামে লাইসেন্স নিয়ে আরেক জনের কাছে হাতি ইজারা দেওয়া হয়েছে, এমন ঘটনাও আমরা পেয়েছি”, বিবিসিকে বলেন রিটকারীর আইনজীবী সাকিব মাহবুব।
কিন্তু হাই কোর্টের আদেশের পর সেই সুযোগ আপাতত বন্ধ হয়ে গেল।
“আদালত যে আদেশ দিয়েছে, সেটি আমরা অবশ্যই মেনে চলবো”, বিবিসি বাংলাকে বলেন বন বিভাগের বন সংরক্ষণ কর্মকর্তা ইমরান আহমেদ।
তবে তারা এখন বিস্তারিত নির্দেশনা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন বলেও জানিয়েছেন।
বাংলাদেশে হাতি সংরক্ষণ ও এ বিষয়ে গবেষণা করে থাকে বন বিভাগ।
সে হিসেবে, পোষা হাতি গুলো ফিরিয়ে নেওয়া হলে সরকারের এই বিভাগই সেগুলোর দেখভালের দায়িত্ব পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে যুগ যুগ ধরেই অনেক পরিবার হাতি পালনের সাথে যুক্ত রয়েছে।
“মূলত তাদেরকে এক ছাতার তলায় নিয়ে এসে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্যই ২০১৭ সাল থেকে আমরা লাইসেন্স দেওয়া শুরু করি”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. আহমেদ।
গত ছয় বছরে মোট ৩৩টি হাতির লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। বাকি প্রায় ৭০টি হাতি লাইসেন্স ছাড়াই পোষা হচ্ছে বলে জানিয়েছে বনবিভাগ।
“তাদের কাছে আগে থেকেই হাতি ছিল। ২০১৭ সালের পর থেকে আমরা বুঝিয়ে সবাইকে লাইসেন্সের আওতায় আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি,”জানান মি. আহমেদ।
“তাছাড়া হাতি দেখভালের মতো পর্যাপ্ত জনবল ও বাজেটও আমাদের নেই”, বলেন তিনি।
মূলত এসব কারণেই ব্যক্তি পর্যায়েই হাতি পালনের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
২০১৭ সালের আগে হাতি পালনের জন্য কোনও লাইসেন্সের প্রয়োজন হতো না।
এরপর ২০১২ সালের বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইনের ক্ষমতায় লাইসেন্স দেওয়া শুরু হয়।
কিন্তু ২০১৯ সালের প্রাণিকল্যাণ আইনে প্রাণির ওপর নিষ্ঠুর নির্যাতন বন্ধের কথা বলা হয়েছে।
“প্রধানত সেই কারণে হাতি পালনে লাইসেন্স দেওয়া বন্ধে নির্দেশনা চেয়ে রিটটি করা হয় এবং আদালত সেটি আমলে নিয়েই আদেশটি দিয়েছে”, বিবিসি বাংলাকে বলেন রিটকারীর পক্ষের আইনজীবী সাকিব মাহবুব।
যত পরিবর্তন
হাই কোর্টের আদেশের ফলে আপাতত ব্যক্তি পর্যায়ে আর কেউ হাতি পোষার লাইসেন্স পাবেন না। যাদের কাছে ইতিমধ্যেই লাইসেন্স রয়েছে, তারাও সেটি নবায়ন করতে পারবেন না।
তবে যারা এখন সার্কাস-সহ অন্যান্য কাজে হাতির ব্যবহার করছেন, সেটির বিষয়ে এখনও সুস্পষ্ট কোনও নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।
তবে পরবর্তী শুনানির পর চূড়ান্ত রায়ে আদেশ বহাল রাখা হলে হাতি দিয়ে আগামীতে কোনও বিনোদন বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানো যাবে না বলে জানিয়েছেন আইনজীবী সাকিব মাহবুব।
ফলে সার্কাসে তখন হাতির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া রাস্তায় টাকা তোলা-সহ অন্যান্য ব্যবসায়িক কাজে যারা এতদিন হাতির ব্যবহার করতেন, আদেশ বহাল থাকলে আগামীতে তারাও হয়তো সেটি আর করতে পারবেন না।
ব্যক্তি পর্যায়ের বাইরে বাংলাদেশে সরকারি কিছু চিড়িয়াখানাতেও হাতি রাখা হয়েছে।
সেখানেও হাতির খেলা বন্ধ রাখতে হতে পারে।
“এক্ষেত্রে বন বিভাগ হয়তো ওইসব হাতির দায়িত্ব পেতে পারে। তবে বিস্তারিত নির্দেশনা পেলেই বিষয়টি পরিষ্কার হবে” বিবিসি বাংলাকে বলেন আইনজীবী সাকিব মাহবুব।
বিনোদন বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ছোট বয়স থেকেই হাতিকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকেন মালিক বা মাহুতরা।
অভিযোগ রয়েছে যে, সে সময় হাতির বাচ্চাকে তার মায়ের কাছ থেকে আলাদা রাখা হয়। এছাড়া অনেকক্ষেত্রে বশে আনতে বাচ্চাকে মারধরও করা হয়।
“প্রশিক্ষণের নামে ওদের সাথে যা করা হয়, সেটি রীতিমত ভয়ঙ্কর ব্যাপার”, বিবিসি বাংলাকে বলেন প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ‘পিপল ফর অ্যানিমাল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রধান রাকিবুল হক এমিল।
“হাই কোর্টের এই আদেশ একটি মাইলফলক। এর ফলে হাতির উপর এতদিন যে নিষ্ঠুরতা চালানো হচ্ছিল, সেটি বন্ধ হবে বলে আশা করি” বলেন তিনি।
এদিকে, অসুস্থ, দলছুট ও মালিকবিহীন হাতির দেখভালের জন্য নেপাল-সহ বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারিভাবে হাতি পরিচর্যা কেন্দ্র বানানো হয়েছে।
বাংলাদেশেও সেই ধরনের দু’টি পরিচর্যা কেন্দ্র বানানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।