বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের যেসব মামলায় গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তাতে তাদের বিচার করে শাস্তির আওতায় আনা কঠিন হতে পারে বলে মত দিচ্ছেন আইনজীবীরা।
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনকালে এসব মন্ত্রী–প্রতিমন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অর্থ-পাচার, আর্থিক খাতে কেলেঙ্কারির যেসব অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে উঠেছে, হত্যা মামলার পাশাপাশি সুনির্দিষ্টভাবে সেগুলোর বিচারও করতে হবে।
বিভিন্ন থানার হত্যা মামলায় এসব আসামিদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাতনামাদের।
আইনজীবীরা বলছেন, যেসব ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়া হচ্ছে এগুলোতে সুনির্দিষ্টভাবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। একইসাথে এসব হত্যা মামলায় আসামি অজ্ঞাতনামা দেখানো হয়েছে।
ফলে এসব মামলায় তাদের বিচার করে শাস্তির আওতায় আনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়তে পারে।
তবে, যদি থানায় করা এসব মামলায় তদন্ত কর্মকর্তার তদন্ত শেষে চার্জশিটে হত্যার ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবেও আসামিদের নাম উঠে আসে সেক্ষেত্রে বিচার সুনিশ্চিত হবে। তাই এতে তদন্ত যথাযথ হতে হবে।
যে হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ও রিমান্ড
কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালে গত ১৬ই জুলাই সহিংসতায় নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষে এক শিক্ষার্থীসহ অন্তত দু’জন নিহত হন।
এ ঘটনায় নিহতদের স্বজনরা বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় দু’টি হত্যা মামলা দায়ের করে। নিহত দু’জন হলেন শাহজাহান আলী এবং সবুজ আলী।
পৃথক ওই দু’টি মামলার অভিযোগেই বলা হয়েছে, ঘটনার দিন অজ্ঞাতনামা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা জামায়াত, শিবির ও বিএনপি নেতা-কর্মীরা এক হয়ে সায়েন্সল্যাব ক্রসিং থেকে বিভিন্ন স্লোগান দিতে দিতে লোহার রড, হকিস্টিক, লাঠি-সোটা ইত্যাদি দেশীয় অস্ত্রসহ নিউমার্কেটের দিকে এগিয়ে আসে।
পরে অজ্ঞাতনামা কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী, শিবির এবং বিএনপি নেতাকর্মীরা রড, লাঠি এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ভিকটিমদের ওপর আক্রমণ করে বলে দুটি অভিযোগেই বলা হয়েছে।
অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার আবেদন করা হয়েছে এসব অভিযোগে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, নৌপথে পালানোর চেষ্টাকালে ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নিউমার্কেট থানার ওই মামলায় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে সেদিন জানিয়েছিল পুলিশ।
একইসাথে বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকু, সাবেক তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলককেও পল্টন থানার এক হত্যা মামলায় দশদিনের রিমান্ড দেয়া হয়েছে।
বিচার নিশ্চিত হবে কীভাবে?
প্রশ্ন উঠেছে হত্যা মামলার মতো ফৌজদারি মামলায় এসব আসামিদের বিরুদ্ধে যেখানে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ নেই সেক্ষেত্রে নিহতদের প্রতি সুবিচার কতটুকু নিশ্চিত হবে? বা তাদের শাস্তির আওতায় কীভাবে আনা যাবে?
আইনজীবীরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী হত্যা মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকতে হয়। কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ তা চিহ্নিত করতে হয়।
তা না হলে হত্যার মতো গুরুতর অপরাধের ক্ষেত্রে অভিযোগের সত্যতা নিয়ে নানা ধরনের সন্দেহ থেকে যেতে পারে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যে মামলাগুলোতে তাদের শ্যোন এরেস্ট দেখানো হয়েছে এগুলোতে যেহেতু অজ্ঞাতনামা আসামি সেহেতু তদন্তকারী কর্মকর্তারা তদন্তের সময় যদি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনতে পারেন তবেই এ মামলাগুলো সঠিকভাবে পরিচালনা করা সম্ভব হবে।”
“অন্যথায় অভিযোগের সত্যতা নিয়ে নানান ধরনের সন্দেহ থেকে যেতেই পারে। বিচার নিশ্চিত করতে হলে অভিযোগ সুনির্দিষ্ট করেই কোনো ব্যক্তিকে ফৌজদারি মামলায় আসামি করা উচিত। এটাই আইনের বিধান, এটাই ফৌজদারি আইনের ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নীতি,” বলেন মি. মনির।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী সিহাব উদ্দিন খান অবশ্য মনে করছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মামলায় যেহেতু গণহত্যার মতো অপরাধে ‘মাস্টারমাইন্ডদের’ বিচার করা গিয়েছে, সেহেতু এই হত্যা মামলায় আসামিদের সরাসরি অংশগ্রহণ না থাকলেও বিচার করা যাবে।
“থানায় করা মামলার ক্ষেত্রে তদন্ত অতীব গুরুত্বপূর্ণ। আসামি অজ্ঞাতনামা হলেও চার্জশিটে যদি মাস্টারমাইন্ড হিসেবে তাদের নাম আসে সেক্ষেত্রে এই মামলায়ও আসামিদের শাস্তির আওতায় আনা যাবে। কিন্তু এফআইআর এর মতো যদি চার্জশিটেও অজ্ঞাতনামা আসামি আসে সেক্ষেত্রে বিচার দুরূহ হবে, ” বলেন মি. খান।
পুলিশের তদন্তের জুরিসডিকশন বিস্তৃত উল্লেখ করে মি. খান বলেন, “এ ঘটনার সাথে আদ্যোপান্ত সকল ঘটনার মোটিভ বিচার্য বিষয় হিসেবে নিতে পারবে তদন্ত কর্মকর্তা।”
“কারা গণহত্যায় নির্দেশ দিয়েছে, পরিকল্পনা করেছে এটাই এখানে যথেষ্ট। অজ্ঞাতনামাদের মৃত্যুও যদি হয়, সকলের দায়দায়িত্ব মাস্টারমাইন্ডদের ঘাড়ে যাবে। এটা একজনকে মারার পরিকল্পনা থেকেও ঘৃন্যতম। কারণ তারা অনির্দিষ্ট সংখ্যক মানুষকে মারার পরিকল্পনা করেছে,” বলেন মি. খান।
মূল অভিযোগের বিচার কতদূর?
সালমান এফ রহমান বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান। ২০০৯ সাল থেকে তিনি শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। যদিও ২০১৭ সালে তার বিরুদ্ধে মামলাটি বাতিল করে দেয় উচ্চ আদালত।
২০১০ –২০১১ সালে শেয়ার বাজারে যে ধস নামে তাতেও নাম উঠে আসে এই আওয়ামী লীগ নেতার। সে সময় যে তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল সেই কমিটির প্রতিবেদনে পুঁজিবাজারকে সালমান এফ রহমানের থেকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেয়া হয়।
২০১৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-১ আসন থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
এছাড়া ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে দুর্নীতি-বিরোধী টাস্কফোর্স করেছিল তাতে বিভিন্ন দেশে যারা টাকা পাচার করেছেন তাদের মধ্যে মি. রহমানের নামও ছিল।
একইসাথে বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণখেলাপীর তালিকায় মি. রহমানের নাম ছিল।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মি. রহমানের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
অন্যদিকে, দেড় দশক আগে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আইনজীবী আনিসুল হক বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং জাতীয় চার নেতা হত্যা মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
বিএনপিবিহীন ২০১৪ সালের নির্বাচনে তিনি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া থেকে আওয়ামী লীগের সমর্থনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
ওই বছরই শেখ হাসিনার সরকারের আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব পান মি. হক। হাসিনা সরকারের পতনের শেষ সময় পর্যন্ত প্রায় দশ বছর দুই দফায় আইনমন্ত্রী ছিলেন মি. হক।
আইনমন্ত্রী থাকার সময়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনসহ নানা বিষয়ে সমালোচিত হন। এমনকি দুর্নীতির অভিযোগও ওঠে তার বিরুদ্ধে।
তবে, অতীতের মতো ঢালাওভাবে যেনতেন অভিযোগ না আনার পরামর্শ দেন আইনজীবীরা। বরং আসামিদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় যেসব অভিযোগ উঠেছে সেগুলোর প্রমাণ নিয়ে তাদের বিচারের উদ্যোগ নিলে তা যথাযথ হবে বলে মনে করছেন তারা। নতুবা আসামিরা জামিন পেয়ে যায় বলে জানান তারা।
এরই মধ্যে আনিসুল হক, জুনাইদ আহমেদ পলকের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। এছাড়া এ সংস্থা সালমান এফ রহমানের অর্থ-পাচারের প্রাথমিক তথ্যও নিয়েছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশে অর্থ-পাচার এবং আর্থিক খাত সংক্রান্ত কেলেঙ্কারির তদন্ত করতে পারে সিআইডি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন।
আইনজীবী শিশির মনির বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন এই বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে আমরা শুনতে পাচ্ছি। দুর্নীতি মামলা করার আগে একটা প্রাথমিক অনুসন্ধান করতে হয়।”
“অনুসন্ধানের পরে মামলা দায়ের করতে হয়। কারো কারো ব্যাংক হিসাবও জব্দ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে আশা করি দুর্নীতি দমন কমিশন যথাযথ তথ্য প্রমাণ সাপেক্ষে আইনগত পদক্ষেপ নেয়ার ব্যবস্থা করবে,” বলেন মি. মনির।
অর্থ কেলেঙ্কারি, দুর্নীতির মামলাও হতে হবে
মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন মি. রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং এবং আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ পুরোনো। একইসাথে গত দশ বছরে সাবেক আইনমন্ত্রী মি. হকের দুর্নীতির অভিযোগও সর্বজনবিদিত।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বিবিসি বাংলাকে বলেন, “ স্বৈরশাসকের দোসর বা সহগামী যাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে অনেক মামলাই দেয়া সম্ভব। অর্থ পাচার, আর্থিক দুর্নীতি, শেয়ারবাজার লোপাটের মামলা , মানুষকে উস্কে দিয়ে বিরোধী দলমতকে নির্যাতনের অভিযোগও আনা সম্ভব”।
মি. খানের মতে আনিসুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি জনগণের স্বার্থে আইনের বিষয়টাকে কখনো দেখতেন না। স্বৈরশাসকের পক্ষে যায় এমনভাবে আইনের প্রায়োগিক দিকগুলো তুলে ধরতেন তিনি। ফলে তাদের বিরুদ্ধে এসব ক্ষেত্রেও অভিযোগ আনার সুযোগ আছে।
“ হত্যা মামলা ছাড়াও যেসব অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে সেই বিষয়গুলো মামলাগুলোতে আসা দরকার। হয়তো এমনও হতে পারে এর পরে আরো বিচার বিশ্লেষণ করে এসব মামলাগুলো দায়ের করবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ” বলেন মি. খান।
অবশ্য সিপিডির বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করছেন এখন শুধুমাত্র তাদের একটা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
পরে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে অর্থঋণ আদালত, শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি, দুর্নীতি বা অন্য মামলাও হতে পারে।
“ আমার মনে হয় এখন শুধু তাদের হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করেছে। অর্থঋণ আদালত বা অন্যান্য আরো অনেক ধরনের মামলা তাদের বিরুদ্ধে পরবর্তীতে আসবে বলে আমার মনে হয়। যেহেতু আসামীদের রিমান্ডে নেয়া হয়েছে তার ভিত্তিতে আরো অনেক বিষয় নিশ্চয়ই উঠে আসবে। সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে আরো মামলা আসতে পারে” বলেন মি. রহমান।