বেশ কিছুদিন পার করে হলেও চীনের সিনোভ্যাক কম্পানির উদ্ভাবিত করোনাভাইরাসের টিকা বাংলাদেশে পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে সরকার। এর মধ্য দিয়ে চীনের এই টিকা বাংলাদেশ সহজে পাওয়ার পথ খুলে গেছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন দেশে অন্য যেসব টিকা নিয়ে কাজ চলছে সেগুলো পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। যে কারণে সিনোভ্যাকের টিকার আগেই অন্য টিকা পেয়ে যেতে পারে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, দেশে যেকোনো টিকার পরীক্ষা হতে পারে।
একাধিক বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না বা ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা তুলনামূলকভাবে আগে ব্যবহার উপযোগী হয়ে আসার সম্ভাবনাকে গুরুত্ব দিচ্ছেন সবাই। সরকারের পাশাপাশি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানও এরই মধ্যে ওই দুটি টিকার উদ্ভাবক কম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। চলতি বছরের মধ্যেই টিকা দুটি দেশে আসতে পারে।
এরই মধ্যে দেশের প্রথম সারির ঔষধ কম্পানি বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেড ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সঙ্গে টিকা নিয়ে সমঝোতা চুক্তি করেছে। এর মধ্য দিয়ে সেরাম উৎপাদিত অক্সফোর্ডের টিকা বাংলাদেশে আনতে পারবে বেক্সিমকো।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে সিনোভ্যাকের টিকা পরীক্ষা হলেও খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই টিকা সাধারণ মানুষের নাগালে আসছে না। তাঁরা বলছেন, এই বছরই সিনোভ্যাকের টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা একেবারেই নেই, এমনকি আগামী বছরের আরো তিন-চার মাস লেগে যেতে পারে। কারণ মূল পরীক্ষা করতেই ছয় মাস চলে যাবে। এর আগে-পরে আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া শেষ করতে কম করে হলেও আরো তিন-চার মাস সময় লাগবে।
যদিও দেশে সিনোভ্যাকের টিকা পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠান আন্তর্জাতিক উদরাময় রোগ গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানী ড. কে জামান কালের কণ্ঠকে গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বলেন, ‘আমরা সবেমাত্র সরকারের অনুমোদন পেলাম। এরই মধ্যে বিষয়টি চীনের সংশ্লিষ্ট কম্পানিকে জানিয়ে দিয়েছি। তারা এখন আমাদের প্রয়োজনীয় নমুনা ভ্যাকসিন (টিকা) পাঠানোর পদক্ষেপ নেবে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সরকারের জায়গা থেকেও আরো কিছু সহযোগিতার প্রয়োজন হবে। পাশাপাশি পরীক্ষামূলকভাবে যেসব চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর এই ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হবে তাদের সঙ্গেও আমাদের আনুষঙ্গিক কিছু কাজ করতে হবে। পাশাপাশি আগে যেসব হাসপাতালে আমরা এই কার্যক্রম পরিচালনা করব বলে ঠিক করেছিলাম সেগুলোর কোনো কোনোটি পরিবর্তন করা হতে পারে। সব মিলিয়ে আমরা চেষ্টা করছি যত দ্রুত সম্ভব পরীক্ষা প্রক্রিয়ায় চলে যাওয়া। এরপর আমরা ছয় মাসের সময় নির্ধারণ করেছি। তবে যদি আগেই আমরা পর্যাপ্ত সফলতা পেয়ে যাই তবে হয়তো আগেই কাজ শেষ করে ফেলতে পারব। পুরো বিষয়টি নিশ্চিত করতে হয়তো আরো সপ্তাহ খানেক সময় লেগে যেতে পারে।’
বেক্সিমকোর পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে জানানো হয়েছে, সেরাম ইনস্টিটিউটে অক্সফোর্ডের টিকা উৎপাদনের ক্ষেত্রে বেক্সিমকো অগ্রিম অর্থ বিনিয়োগ করবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে আলোচনাসাপেক্ষে টিকার মূল্য নির্ধারণ করা হবে। সরকারকে চাহিদা অনুযায়ী টিকা সংগ্রহ করে দেওয়া এবং দেশের বেসরকারি বাজারে সরবরাহ নিশ্চিত করবে বেক্সিমকো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ন্যাশনাল ইমিউনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপের (নাইট্যাগ) একাধিক সদস্য কালের কণ্ঠকে বলেন, প্রথমত সরকার চীনের টিকা পরীক্ষার অনুমতি দিতে অনেকটা দেরি করে ফেলেছে। অন্যদিকে এই টিকার পরীক্ষা আরো কয়েকটি দেশে শুরু হয়েছে। সব টিকার পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর বাকি প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে। আবার উৎপাদনকেন্দ্রিক কিছু সময় লেগে যাবে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনের টিকা বাংলাদেশে পরীক্ষার প্রয়োজন হবে না। সেগুলোর জন্য শুধু সংগ্রহপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিলেই হবে। যে কাজ এরই মধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায় থেকে শুরু হয়েছে।
ওই বিশেষজ্ঞরা জানান, সরকারের তরফ থেকে যেহেতু কয়েকটি দেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা হচ্ছে, ফলে যেই টিকা আগে ব্যবহার উপযোগী হবে, সেটি কম পরিমাণে হলেও বাংলাদেশ পাবে। অবশ্য বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্যাভির (দ্য গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমিউনাইজেশনস) সমন্বিত ‘কোভ্যাকস’ জোট থেকে টিকা পেতে কিছুটা দেরি হতে পারে। এই জোট থেকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০ শতাংশের জন্য প্রয়োজনীয় টিকা আসবে বিনা মূল্যে বা খুব স্বল্প মূল্যে। এর বাইরে বেসরকারি ঔষধ প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারের তরফ থেকে টাকা দিয়ে কিনে আনলে তা আরো দ্রুত সময়ের মধ্যে পাওয়া যাবে। যদিও এ ক্ষেত্রে দাম বেশি পড়বে।
নাইট্যাগের একজন সদস্য বলেন, যেহেতু পাশের দেশ ভারতের বড় কম্পানি সেরাম ইনস্টিটিউটে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার আওতায় থাকা টিকার উৎপাদনপ্রক্রিয়া চলছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে ভারতের সঙ্গে এ বিষয়ে জোরালো কথাবার্তা হয়েছে। তাই আশা করা যায়, সবার আগে হয়তো ওই টিকা বাংলাদেশ পাবে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য খাতের বহুমাত্রিক শক্তিশালী সাহায্যদাতা হিসেবে যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পাশে রয়েছে, তাই সেই সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রে উৎপাদিত টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অগ্রাধিকার পাবে। দেশের ঔষধনীতি ও আইন অনুযায়ী যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের সাতটি দেশের ওষুধের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রয়োজন হবে না। সেদিক থেকেও যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের টিকা বাংলাদেশকে কিছুটা এগিয়ে রাখবে। এমনকি জার্মানির ফাইজার কম্পানির টিকা একই ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশের হাতে আগেভাগে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. শামসুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ ডোজ টিকা পাবে। টিকা পাওয়ার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
সিনোভ্যাকের টিকা আগেভাগে পাওয়ার ক্ষেত্রে ঝুঁকিতে থাকা জনগোষ্ঠীর অগ্রাধিকারের বিষয়টিও প্রভাব রাখবে। কারণ দেশে সিনোভ্যাকের টিকা পরীক্ষার জন্য নির্দিষ্ট ব্যক্তির মধ্যে শিশু বা বয়স্ক ব্যক্তি নেই। যে চার হাজার ২০০ জনকে পরীক্ষার আওতায় আনার কথা বলা হচ্ছে, তাঁরা সবাই স্বাস্থ্যকর্মী। এই কারণে ভবিষ্যতে শিশু কিংবা বয়স্কদের মধ্যে এই টিকার কার্যকারিতা কতখানি থাকবে, সেটাও আগাম বলার উপায় নেই। অন্য টিকাগুলোর মধ্যে একাধিক টিকা রয়েছে, যা বয়স্কদের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।