অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য প্রায় আট লাখ কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব করেছেন। এবারের বাজেট বক্তব্যের শিরোনাম করা হয়েছে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’। সাধারণত প্রস্তাবিত বাজেটের উপর সংসদে আলোচনা শেষে কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্ধন, পরিমার্জন এলে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে দেখা যায় না। এক নজরে দেখে নেয়া যাক নতুন বাজেটের আটটি দিক।
আয়কর
বাজেটে সবার দৃষ্টি থাকে আয়করের দিকে। বিশেষ করে যারা চাকরিজীবী তাদের জন্য এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রস্তাবিত বাজেটে দেখা যাচ্ছে, করমুক্ত আয়ের সীমায় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি।
করধাপের ক্ষেত্রে এবার কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়েছে। যাদের আয় বেশি তাদের ক্ষেত্রে আয়কর বেশি দিতে হবে।
এবারের বাজেটে করধাপে সর্বোচ্চ স্তর নির্ধারণ করা হয়েছে ৩০ শতাংশ। যাদের মোট বাৎসরিক আয় ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি তাদের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ আয়কর প্রযোজ্য হবে।
অর্থাৎ ৩৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি আয় হলে সেই আয়ের ওপর ৩০ শতাংশ কর দিতে হবে।
রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেট
একটি বাজেটের দুটি অংশ থাকে। একটি অংশ হচ্ছে রাজস্ব বাজেট এবং অপরটি হচ্ছে উন্নয়ন বাজেট।
রাষ্ট্রের প্রশাসনিক কাজ পরিচালনার জন্য প্রতিবছর যে ব্যয় ধরা হয় এবং সরকার বিভিন্ন ধরনের কর থেকে যে টাকা আদায় করে সেটিকে বলা হয় রাজস্ব বাজেট।
এছাড়া অবকাঠামোসহ নানা ধরনের উন্নয়নমূলক কাজের জন্য যে ব্যয় ধরা হয় সেটিকে উন্নয়ন বাজেট বলা হয়।
প্রস্তাবিত প্রায় আট লাখ কোটি টাকার বাজেটের মধ্যে রাজস্ব বাজেট হচ্ছে ৫ লাখ ৩২ হাজার কোটি টাকা।
অর্থাৎ এই টাকা রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে ব্যয় করা হবে। যার মধ্যে রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেতন-ভাতাসহ নানা বিষয় অন্তভুর্ক্ত।
উন্নয়ন বাজেট হচ্ছে দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। উন্নয়ন বাজেটের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে, যেটি প্রায় ৭১ হাজার কোটি টাকা।
কোন খাত সর্বোচ্চ বরাদ্দ
সরকার যে বাজেট উত্থাপন করেছে সেখানে দেখা যাচ্ছে, সবচেয়ে বেশি খরচ হবে ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে। প্রায় ৮ লাখ কোটি টাকা বাজেটের ১৪.২ শতাংশ খরচ হবে ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে, যার পরিমাণ ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত বাজেটে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে। মোট বাজেটের ১৪ শতাংশ এই খাতে খরচ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। যার মোট পরিমাণ ১ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা।
বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ ব্যয় করা হবে মোট বাজেটের ১১.১ শতাংশ, যার পরিমাণ ৮৮ হাজার কোটি টাকার বেশি।
এছাড়া পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ব্যয় করা হবে ১০.২ শতাংশ, যার পরিমাণ ৮১ হাজার কোটি টাকার বেশি।
টাকা আসবে কোথা থেকে?
প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা। বাকি দুই লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা সরকার ঋণ নেবে। যার মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি, বিভিন্ন ধরনের বন্ড বিক্রি এবং ব্যাং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়া।
বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ ও অনুদান নেবে ৯৫ হাজার কোটি টাকা। এবং অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা কর আদায় করবে। আদায়ের উপায়ের মধ্যে রয়েছে ভ্যাট, আমদানি শুল্ক, আয়কর, সম্পূরক শুল্ক।
ব্যাংকে টাকা রাখলে খরচ বাড়বে
১০ লাখ ১ টাকা থেকে ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যাংকে থাকলে আবগারি শুল্ক দিতে হবে তিন হাজার টাকা। ৫০ লাখ ১ টাকা থেকে এক কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যাংকে থাকলে দিতে হবে পাঁচ হাজার টাকা। এক কোটি ১ টাকা থেকে দুই কোটি টাকা পর্যন্ত ব্যাংকে থাকলে আবগারি শুল্ক দিতে হবে ১০ হাজার টাকা। এছাড়া দুই কোটি এক টাকা থেকে পাঁচ কোটি পর্যন্ত টাকা থাকলে আবগারি শুল্ক দিতে হবে ২০ হাজার টাকা।
কমিউনিটি সেন্টার, মোবাইল ফোন
কমিউনিটি সেন্টার কিংবা কনভেনশন সেন্টারে বিয়ে, জন্মদিন কিংবা যে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গেলে আয়কর রিটার্ন দেখাতে হবে। আয়কর রিটার্নের প্রমাণ ছাড়া কমিউনিটি সেন্টারে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা যাবে না।
বিদেশ থেকে আসার সময় একজন ব্যক্তি তার ব্যবহৃত সর্বোচ্চ দুটি ফোন সেট শুল্ক ছাড়া আনতে পারবেন। এর পাশপাশি তিনি একটি নতুন ফোনসেট শুল্ক পরিশোধ করে আনতে পারবেন।
সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে শুল্ক
বাংলাদেশে জাতীয় সংসদের সদস্যরা এতো বছর ধরে বিনা শুল্কে বিদেশ থেকে গাড়ি আমদানি করে আসছেন। কিন্তু এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানির ওপর শুল্ক বসানের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
সেক্ষেত্রে গাড়ির আমদানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ শুল্ক এবং আমদানি পর্যায়ে ২৫ শতাংশ ভ্যাট বসানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
তিনি তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “সকল স্তরে কর অব্যাহতির সংস্কৃতি হতে বের হয়ে আসার জন্য সবাইকে রাজস্ব প্রদানে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।”
“জনপ্রতিনিধি হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনের লক্ষ্যে মাননীয় সংসদ সদস্যগণের সকল প্রকার শুল্ক কর পরিশোধ ব্যতিরেকে গাড়ি আমদানির প্রাধিকার কিছুটা পরিবর্তন করা একটি মহৎ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।”
কালো টাকা ও সম্পত্তি সাদা করা
প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করা এবং অপ্রদর্শিত সম্পদ নিদ্দির্ষ্ট হারে কর দিয়ে বৈধ করার কথা বলা হয়েছে।
যেমন, কোনো ব্যক্তি যদি তার প্লট বা ফ্ল্যাট গোপন করে থাকেন তাহলে তিনি নিদ্দিষ্ট হারে কর দিয়ে সেটি বৈধ করতে পারবেন।
অন্যদিকে, অপ্রদর্শিত টাকার ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সেটি বৈধ করা যাবে। আয়কর ফাইলে দেখানো হয়নি এমন সম্পদকে কালো টাকা বা সম্পদ হিসেবে বর্ণনা করেন অর্থনীতিবিদরা